বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার রাতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, মূলত তিন কারণে আরও ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রমাগত প্রকৃত আয় কমে যাওয়া; দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্থরগতি।
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে শ্রমবাজারের দুর্বল অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের প্রকৃত আয় কমতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথগতির কারণে ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র মানুষের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে। এতে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে।
অবশ্য বিশ্বব্যাংক বলেছে, আগামী দুই বছরে চরম দারিদ্র্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। ২০২৬ সালে চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২৭ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে।
শুধু অতিদারিদ্র্যের হার নয়; জাতীয় দারিদ্র্যের হারও বাড়তে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, জাতীয় দারিদ্র্যের হার গত বছরে ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে হতে পারে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোভিডের সময় ছাড়া গত তিন দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়েনি। দারিদ্র্য কমানোর সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ পুরো বিশ্বে অনুকরণীয়। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস ঢাকায় পালন করেছে বিশ্বব্যাংক।
দারিদ্র্য পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা দিয়ে দরিদ্র মানুষ চিহ্নিত করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে, দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতিদরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
তবে প্রতিটি দেশের জন্য নিজস্ব একটি দারিদ্র্যরেখা ঠিক করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ড হলো খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন বা দরিদ্র হয়ে যাবেন। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপে ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রাখে বিবিএস।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুসারে, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সাল শেষে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা হতে পারে ১ কোটি ৫৮ লাখের মতো। আর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হতে পারে ৩ কোটি ৯০ লাখের মতো।
যে কারণে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়তে পারে
দেশে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়ছে না। এতে প্রকৃত আয় কমেছে সাধারণ মানুষের। ৩ বছর ৩ মাস বা ৩৯ মাস ধরে বাংলাদেশে মজুরির হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরির হার বৃদ্ধি বেশি ছিল। এরপর ৩৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। তিন বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। ধরুন, আপনার প্রতি মাসে আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং সেই অনুযায়ী আপনার আয় না বাড়লে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্লথগতি। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ—এসব সূচকে চাঙা ভাব নেই। ৯ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ছয় বছরের মধ্যে এডিবি বাস্তবায়ন সবচেয়ে কম। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা খরচ গতবারের চেয়ে কমেছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও কমেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ কম। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়।
এ ছাড়া দুর্বল শ্রমবাজার আগের মতো বিরাজমান। ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যাঁরা অনানুষ্ঠানিক খাতে দিনমজুরের মতো কাজ করেন, তাঁদের চাকরি বা কাজের নিশ্চয়তার ঝুঁকি বেশি থাকে।
অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা করতে হবে
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ দেশে এমন অনেক পরিবার বা মানুষ আছেন, যাঁরা বছরে যদি দুই দিনও কাজ না পান, তাহলে তাঁরা দরিদ্র হয়ে পড়েন। তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান। বিষয়টি অনেকটা এমন যে এ দেশে ‘টোকা’ দিলেই অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যান। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে, সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার মতো কোটি কোটি পরিবার নেই। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবার যেকোনো সময় দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
এই অর্থনীতিবিদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত মজুরি ক্রমাগত কমছে। প্রায় সব উন্নয়ন-সহযোগীর পূর্বাভাস অনুসারে, এ বছর ৪ শতাংশের মতো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে। প্রবৃদ্ধিতে মন্দা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে পারে। তাই অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা করতে হবে।